--- বিজ্ঞাপন ---

মোসলেম কারাগারে সশস্ত্র অবস্থায় এসে বলে, আমি তাদের গুলি করবো

কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় ৪ নেতাকে

0

কত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪ কান্ডারী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী  সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এ এইচএম কামরুজ্জামান। স্বাধীনতার পর এ দেশে বসবাসরত পাকিস্তানী হানাদার দোসররা ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে হত্যা করে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুকে। এর পরের টার্গেট ছিলেন জাতীয় ৪ নেতা। কারাগারে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হয়। জেল হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান। তার জবানবন্দীতে উঠে আসে কিভাবে হত্যা করা হয়েছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী  সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এ এইচএম কামরুজ্জামানকে।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান কে নির্মমভাবে হত্যার পর মৃতদেহগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি হয় সেদিন সন্ধ্যায়। রাতে মৃতদেহ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই ঘটনার ব্যাপারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন ৪ নভেম্বর লালবাগ থানায় একটি ডায়েরি করেন। ডাইরিটি যখন করা হয়, তখনও মৃতদেহগুলো অযত্নে পড়েছিল কারাগারেই। ওই ডাইরিতে বলা হয়, ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তীতে জানানো হবে। পরবর্তিতে এই ডায়রি গায়েব করা হয়। এতে যে বিবরণ, মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট, ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আইজি ও ডিআইজি প্রিজন এর বক্তব্য ছিল।

পরবর্তিতে এ বিষয়ে ব্যাপক ফাইল চালাচালি হয়। ফাইলটির বিভিন্ন চিঠিপত্র দেখে বোঝা যায় । ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ নিয়ে ব্যাপক চিঠি চালাচালি হয় জেলা প্রশাসন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে। পরে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। এই দলিল ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান। তিনি বলেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাত প্রায় সাড়ে তিনটায় আমি বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদ এর টেলিফোন পাই। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কোন সমস্যা আছে কিনা তা তিনি জানতে চান। আমি তাকে বলি এই মুহুর্তের অবস্থা আমার জানা নেই। তিনি আমাকে কারাবন্দিদের সতর্ক করে দিতে বলেন। তার কারণ কিছু সশস্ত্র সৈন্য বলপূর্বক কয়েকজন বন্দিকে বাইরে নিয়ে যাবার জন্য জেল গেটে উপস্থিত হতে পারে। সে অনুযায়ী আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফোন করি এবং গেটের ডিউটিরত ওয়ার্ডার কে বলি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। সে যেন জেলারকে খবর দেয়। প্রায় ৩/৪ মিনিট পরে বঙ্গভবনের অবস্থানরত আরেক জন সেনা অফিসারের কাছ থেকে আমি আর একটি টেলিফোন পাই। তিনি জানতে চান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রক্ষীদের আমি ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছি কিনা। আমার তরফ থেকে ইতিবাচক জবাব পেয়ে তিনি আমাকে নিজে গিয়ে প্রহরার অবস্থা দেখার নির্দেশ দেন। আমি তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি প্রিজন কে ফোন করে গৃহীত ব্যবস্থার কথা অবহিত করে তৎক্ষণাৎ জেলগেটে যাবার নির্দেশ নির্দেশ দিই। আমি সঙ্গে সঙ্গে গেটের কাছে ছুটে গিয়ে ইতিমধ্যে সেখানে হাজির জেলারকে আবার রক্ষীদের কে সতর্ক রাখার কথা বলি। ডিআইজি এর মধ্যে জেলগেটে পৌঁছে গেছেন। বঙ্গভবন থেকে পাওয়া বার্তার কথা আমি তাকে আবারও জানাই। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেজর রশিদ এর আরেকটি ফোন পায়। তিনি বলেন, জনৈক মোসলেম অল্পসময়ের মধ্যে জেলখানায় যাবেন এবং আমাকে কিছু বলবেন। তাকে জেল অফিসে নিয়ে কিছু বন্দীদের দেখিয়ে দিতে হবে। তারা হলেন জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, জনাব মনসুর আলী, জনাব  সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব কামরুজ্জামান। এই বিষয়টির ব্যাপারে আমি রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক এর সঙ্গে কথা বলতে চাই। সে অনুযায়ী তাকে টেলিফোন দেয়া হয়। আমি কিছু বলার আগে রাষ্ট্রপতি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, মেজর রশিদ এর দেয়া নির্দেশ আমি বুঝতে পেরেছি কিনা। আমার ইতিবাচক জবাব পেয়ে তিনি আমাকে সে নির্দেশ পালন করতে বলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে চারজন সশস্ত্র সৈন্যের সঙ্গে জেলগেটে এসে পৌঁছান ক্যাপ্টেন মোসলেম। তার পরনে কালো পোশাক। ডিআইজি প্রিজন এর অফিস কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে তিনি আমাকে পূর্বে উল্লেখিত বন্দিরা যেখানে আটক আছেন তাকে সেখানে নিয়ে যেতে বলেন। আমি তাকে বলি বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী আমাকে তার কিছু বলার কথা রয়েছে। এ কথার জবাবে তিনি বলেন, সে তাদেরকে গুলি করবে। এই প্রস্তাব শুনে আমরা সকলে বিমুঢ় হয়ে পড়ি। ডিআইজি প্রিজন এবং আমি নিজে রাষ্ট্রপতি সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি কিন্ত তাতে ব্যর্থ হই। এ সময় বঙ্গভবন থেকে আবার মেজর রশিদ এর আরেকটি ফোন আসে জেনারেল টেলিফোনে। আমি রিসিভার তুললে মেজর রশিদ জানতে চান, ক্যাপ্টেন মোসলেম পৌঁছেছেন কিনা। আমি হাঁ সুচক জবাব দিয়ে বলি ব্যাপার কি। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। তখন তিনি আমাকে টেলিফোনে রাষ্ট্রপতি সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি রাষ্ট্রপতিকে ক্যাপ্টেনের ইচ্ছার কথা উল্লেখ করে বলি ‘তিনি বন্দীদের গুলি করতে চান’। জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন সে যা বলছে তাই হবে। এতে আমরা খুবই উত্তেজিত হয়ে ওঠে।ক্যাপ্টেন তখন সেখানে উপস্থিত দিয়ে ডিআইজি ( প্রিজন) জেলর, অন্যান্য নির্বাহী ও আমার দিকে অস্ত্র তাক করে। যে ওয়ার্ডে উল্লেখিত বন্দীদের রাখা হয়েছে তাদের কে সেখানে নিয়ে যাবার হুকুম দেন। ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীরা এতোই ক্রোধান্বিত ছিলেন যে যা দেখে সেদিন নির্দেশ অগ্রাহ্য করার সাহস পায় নি। নির্দেশ অনুযায়ী পূর্বে উল্লেখিত চার বন্দিকে অন্যদের থেকে আলাদা করে এনে একটি কক্ষে রাখা হয়। জেলর সেখানে তাদেরকে শনাক্ত করেন। এরপর ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীরা গুলি চালিয়ে বন্দীদেরকে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে সৈন্যদের আরেকটি দল বন্দীদের সকলে নিহত হয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত হতে কারাগারি আছে। তারা সরাসরি ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ে এবং আবার বন্দীদের মৃতদেহের বেয়নেট চার্জ করে।

জনকন্ঠ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর দীর্ঘ ৮ বছরেরও বেশি সময় বিচার চলার পর বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার শাস্তি এবং অপর ৫ জনকে খালাস দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক তিনজনের ফাঁসি ও অপর ১২ জনের যাবজ্জীবন হয়।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলো- দফাদার মারফত আলী শাহ, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ওরফে হিরণ খান ও এলডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধা। যাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয় তারা হলো- কর্নেল (অব). সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সৈয়দ শাহরিয়ার রশীদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ (বরখাস্ত), লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) এমএইচএমবি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) কিসমত হোসেন ও ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার। খালাসপ্রাপ্তরা হলো- বিএনপি নেতা মরহুম কে এম ওবায়দুর রহমান, জাপার শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক মন্ত্রী মরহুম তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুর ইসলাম মঞ্জুর ও মেজর (অব.) খায়রুজ্জামান।

২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে কেবল রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের ফাঁসি বহাল রেখে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধা ও যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত অপর চার আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ওই চার আসামির চারটি আপীল ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ রায় দেন।

তবে জেল হত্যাকান্ডের সুদীর্ঘ সময় পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় নেতার পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন মহল থেকে সে সময়ই রায়টিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘প্রহসনের রায়’ বলে আখ্যায়িত ও প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাদের অভিযোগ, জেলহত্যা ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। জাতির ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকান্ডের পুনর্তদন্ত ও পুনর্বিচার দাবি করেন তারা।

অবশ্য জেলহত্যা মামলায় খালাস পেলেও লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ- এই চারজন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় ’১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে পলাতক অপর আট যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামির সম্পর্কে কোন মতামত না দেয়ায় তাদের দন্ড বহাল আছে বলে আইনজীবীরা ব্যাখ্যা দেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ায় জেল হত্যাকান্ডের পুনর্বিচারের সুযোগ আসে। ’১২ সালের ১ নবেম্বর সরকারপক্ষ জেলহত্যা মামলার আপীল বিষয়ে সারসংক্ষেপ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে জমা দিলে পুনর্বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ’১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপীল বিভাগের চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত রায়ে ২০০৮ সালের হাইকোর্টের রায় বাতিল করে ২০০৪ সালের নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখা হয়। অর্থাৎ পলাতক তিন আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরণ খান, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধার ফাঁসি এবং অন্য ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল থাকে। সুদীর্ঘ বছর পর বাঙালী জাতি পায় কাংখিত বিচার।###৮.১২.১৯

 

 

আপনার মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.